সুনসান নীরব চারিদিক। অপরাহ্ণে হেলে পড়েছে সূর্য। রোদে চিকচিক তপ্ত শরীর নিয়ে ইস্পাতগুলো শুয়ে আছে সারি সারি পেতে রাখা কাঠের বিছানায়। গা ঘেঁষে জমিয়ে রাখা শিলা পাথর, আর পাথরের ফাঁকে বেড়ে ওঠা ঘাসের সাথে নরম বাতাসে হেলেদুলে চলে বিষণ্ন বন্ধুতা। নিঃসঙ্গ প্লাটফরম, মানুষ আসে যায়, কেউ দিনভর থাকে না আগের মতন। সবার মন খারাপে ছন্দপতন নয়, ছন্দযোগ ঘটায় সুকঠিন লোহার চাকার কর্কষ ঘর্ষন। তবে বেশী দেরী হয়নি, তাদের পুরণো বন্ধু ফিরে এসেছে, নতুন এক অবয়বে। যার আত্মীয়তার ছোঁয়া ছিল সারাবেলা, যার ঘাম ঝরে পড়ে শুকোতো তাদের গায়ে….তিনি শয্যা নিয়েছেন তাদের পাশেই। সদ্য লাগানো বাঁশের বেড়া আর চাটাই রুখতে পারে না পুরণো বন্ধুদের আত্মার মিলনে!
এক।
স্টেশনঘেষা টি-স্টলটায় নিযমিত চায়ের আড্ডা। ছোট্ট একটা টিভিতে বাংলা সিনেমা, আজকাল অবশ্য ক্যাবল টিভির সুবাদে হিন্দি সিনেমাও চলে। কেউ কেউ দেখে, তবে বেশীর ভাগেরই মন খোশগল্পে। বরাবরের মতই আলোচনার মধ্যভাগে তালেব মাস্টার। এলাকায় নতুন কেউ তাকে শিক্ষক ভাবে। পরে জানতে পারে, স্থানীয় পরানপুর রেলস্টেশন আর তালেব মিয়া এক স্বত্বা হিসেবে হয়ে গেছে তালেব মাস্টার।
-দেশ স্বাধীন হইছে বছর খানেক, দলে দলে লোকজন শহরমূখী, তাই ট্রেনভর্তি মানুষ। বাবা ছিলেন টিএন্ডটিতে, টেলিগ্রাফ মাস্টার। বদলী হইছেন কুমিল্লা থেকে নারায়নগঞ্জে। মেইল ট্রেনে আমরা গাদাগাদি কইরা….মা বাবা একমাত্র বোন আর আমি। কষ্টে সৃষ্টে আগলাইয়া রাখা মাল-সামান।……’’ এভাবেই চলে তালেব মাস্টারের স্মৃতি বয়ান। পরিচিত জনের কাছে বেশীর ভাগ কাহিনীই জানা। মাঝে মাঝে পুনরাবৃত্তির বাইরে নতুন কিছু বলেন।
সরল একরৈখিক জীবন তালেব মাস্টারের। বয়স ষাটের কাছাকাছি। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে কাজ করে যাচ্ছেন গত কয়েক বছর ধরে। এপার ওপার দুইদিকে নজর বুলিয়ে আর লাল সবুজ পতাকা হাতে ছুটতে ছুটতে এক জীবন কেটে গেলো। নিরাপদে ট্রেন পার করা, আর কিছু যাত্রীসেবা-এই কাজ তার। সমান্তরাল দুটি লাইন….তার জীবনটিও যেন এই সমান্তরাল দুটি লাইনের মতই। এক লাইনে চাকরি, আরেক লাইনে ব্যক্তি পরিবার। দৃষ্টির শেষ সীমায় যেমন দুটি লাইন মিশে একাকার হয়। তার জীবনটিও বেশ অনেক বছর ধরে এক লাইনে চলছে। রেলগাড়ির ঝিক ঝিক, লাইন ক্লিয়ার, দোলানো পতাকা, সিগনাল আপ-ডাউন….আর পারাপারের মানুষ দেখা।
খুব ছোট্ট স্টেশন পরানপুর্। ‘বি’ শ্রেণীর স্টেশন হলেও অবকাঠামো সেই পুরণোই রয়ে গেছে। এলাকায় দেন-দরবার করার মত তেমন কোন হোমরা-চোমরা না থাকায় রিমডেলিং হয়নি। তিনজন মাত্র স্টাফ। মাস্টার তালেব মিয়া, বুড়ো পয়েন্টসম্যান জলিল, আর পোর্টার ফখর মিয়া। কোন ইন্টারসিটি ট্রেন থামে না। একটি মেইল, দুটি লোকাল, আর একটি কমিউটারের স্টপেজ আছে এখানে। গুডস তেমন বুক হয় না এখান থেকে।
বিকেল হয়ে এসেছে। আঁধার হওয়ার আগেই এক চক্কর দিযে আসতে হবে। আগামী দু’ঘন্টার মধ্যে কোন ট্রেন নেই। সাতটায় ৭২২ ইন্টারসিটি, থ্রু পাস হবে। তারপর সাড়ে সাতটায় নাইন আপ মেইল, এটার স্টপেজ আছে। বৈকালিক হাঁটা। সাথে সাথে অভ্যাসবশত মেইন লাইন, লুপ লাইন, লাইনের ক্রসওভার জয়েন্ট, ফেসিং পয়েন্ট ঘুরে ঘুরে চেক করা তালেব মিয়ার পুরণো রুটিন। যদিও এগুলো তার কাজ নয়। প্রতিদিনের মত আজো হাঁটতে হাঁটতে দক্ষিণ দিকের লেভেল ক্রসিং, আউটার সিগনাল পার হয়ে অনেকটা দূর চলে আসে। ১৮১/৩ কিলোমিটার পোস্টের সাথেই ছোট্ট একটা পিলার। লাল একটা ক্রসচিহ্ন দেয়া।
প্রতিদিন অন্ততঃ একটিবার সে এখানে আসে। এতটি বছর, তবু স্মৃতি একটু মলিন হয় না। আজ যেন একটু বেশী স্মৃতিকাতর হয় সে। আজ যে ২৭ মে। আটচল্লিশ বছর ধরে যেই ঘটনা বয়ে বেড়াচ্ছে সে, রেল লাইনের সাথে তার যে আত্মীয়তা, তার সূত্র যে এখানেই জুড়ে আছে! আনমনে কখন যেন নরম ঘাসে বসে পড়ে। আজ আর হাঁটতে মন চাইছে না।
দুই।
….কয়লার ইঞ্জিনে চলা মেইল ট্রেনটির ‘কু…ঝিক ঝিক’ এর সাথে তাল মিলিয়ে নানা রকম ছড়া কেটে কখন যেন ঝিমুনি এসে গেছিল ক্লাস সিক্সে পড়া ১১/১২ বছরের বালকটির। গা ঘেঁষে বসা মা আর ছোট বোনটিও ঘুমিয়ে। বাবা সিট পাননি। পাশেই হেলান দিয়ে দাঁড়ানো। …..আকাশ ভেঙে পড়া আওয়াজ আর প্রচণ্ড ঝাঁকুনিকে তন্দ্রা ভাঙে তার। শত শত মানুষের আর্ত চিৎকার আর লণ্ডভণ্ডের মাঝে সংজ্ঞা হারায় সে। জ্ঞান ফিরে নিজেকে রেললাইনের পাশে মাটিতে শোয়া আবিষ্কার করে। কয়েক সেকেন্ড লাগে ঘোর কাটতে। চারিদিকে শুধু রক্ত আর ভাঙাচুড়া লোহার টুকরা। নিজের শরীরের জখম ভুলে মা-বাবা ভাই বোনের কথা মনে পড়ে। তাকিয়ে দেখে- আকাশ ছুঁতে চাইছে দৈত্যাকার ইঞ্জিন, একটি ট্রেনের উপর আরেকটি ট্রেন উঠে পড়েছে….দিক বিদিক ছুটছে মানুষ। আহত মানুষ আর সাহায্যকারীদের চিৎকারে তার দিকে নজর দেয়ার কেউ নেই।
প্রকৃতির এক অদ্ভূত নিয়ম। যেই ছোট্ট বালকটি একটু আগে মা-বাবার ছায়ায় আদরে বেড়ে ওঠা চারাগাছ। তাকেই নিমিষে বেড়ে উঠে হয়ে উঠতে হলো মহীরুহ। দায়িত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবে সে খুঁজে নিল মা-বাবা বোনকে। এত বড় দূর্ঘটনার ধাক্কা, নিজের শরীরের ক্ষত- কর্তব্যবোধ সব ভূলিয়ে দিল। তিনজনের জন্যই উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারলো। তারা এখন প্লাটফরমের পরিষ্কার স্থানে সাদা চাঁদরে শুয়ে। তিনজনকে একসাথেই পাওয়া গেছিল। বাবার কালো শরীরটি লাল হয়ে গেছে। বোনটির টকটকে ফর্সা মুখে কে যেন মেহেদী মাখিয়ে দিয়েছে। মা….শুধু তাকেই প্রায় অক্ষত পেল। তাকিয়েই ছিলেন। ছেলেকে দেখে কিছু একটা যেন বিড়বিড় করে বলেছিলেনও। পরিণত মানুষ হলে হয়তো তালেব খেয়াল করে মায়ের শেষ কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করতো।
লাশ সনাক্তকরণ, আইনগত কিছু প্রক্রিয়া শেষে স্বজনদের রেল পুলিশের জিম্মায় রেখে নিজেকে ফিরে পেল, ফিরে এলো নিজ বয়সে। হাঁটু মুড়ে কান্নায় ভেঙে পড়া তালেবের কানে ঢুকলো….কেউ উচ্চস্বরে ৩৫,৩৬,৩৭ নম্বর লাশের দাবীদার আবু তালেবকে খুঁজছে।
নতুন জায়গায় কোথায় যাবে ঠিকানা জানে না সে। গ্রামের বাড়ি চিনে ফিরতে পারবে। তবে পকেটে কোন টাকা-পয়সা নেই। উঠে গিয়ে বাবার মৃতদেহের কাছে গিয়ে বসলো। পরিস্থিতি বাধ্য করেছে। বাবার পকেটে মানিব্যাগ থাকার কথা। এই অসময়ে কাজে দেবে, যা ই পাওয়া যায়। নিদেনপক্ষে কারো ঠিকানা কিংবা টেলিফোন নাম্বার। নাহ, মানিব্যাগ বা খুচরা কোন টাকা-পয়সাই নেই। হয়তো পড়ে গেছে কোথায়, নয়তো সাহায্যকারীরা সরিয়ে নিয়েছে।
সেই সাত সকালে ভাত খেয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছে। ট্রেনে একটু ঝালমুড়ি খেয়েছিল। সকল অনুভূতি প্রায় শূন্য হয়ে গেলেও উঠতি বয়স, শরীর তাগাদা দিচ্ছে। স্থানু বসে থাকা বালকটির পিঠে কেউ মৃদু টোকা দিল।
-তোমার কি কেউ মারা গেছে?’’ একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক।
কোন ঠক, মতলববাজ মনে হলো না। নির্ভর করতে ইচ্ছে করে এমন চেহারার মানুষ। আর ওর আছেই কী আর হারাবার। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো তালেব। ভদ্রলোক সব শুনলেন।
তিন।
এক পথ এক গতিতে চলা জীবনটি, একটি দুর্ঘটনা এক ঝটকায় পাল্টে দিয়েছিল বালকটির বর্তমান। জীবনের গতিপথ আবার নতুন দিকে মোড় নিল। অনাথ আশ্রয়হীন ছেলেটিকে মোফাজ্জল সাহেব নতুন জীবন দিলেন। তিনি রেলওয়ের একজন মাঝারি গোছের প্রকৌশলী। দুর্ঘটনা পরবর্তী হাজার দায়িত্বের ফাঁকে তিনি ছেলেটির জন্য তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিলেন। মেইন লাইন ব্লক হয়ে আছে, দ্রুতই লাইন পরিষ্কার করতে হবে। রিলিফ ট্রেনে উদ্ধার কাজ তদারকিতে ব্যস্ত মোফাজ্জল সাহেব তালেবের পিতামাতা বোনের লাশের সদগতির দিকে নজর দিতে পারলেন না। অন্যান্য বেওয়ারিশ লাশের মত তালেবের স্বজনদের লাশ আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের লোকজন নিয়ে গেল। কীই বা করার ছিল অতটুকু বালকের!
মোফাজ্জল সাহেব তালেবকে ঢাকায় নিয়ে গেলেন। পরিবারটিতে প্রাচূর্য ছিল না, তবে ওর বয়সের একটি ছেলের থাকা থাওয়ার ব্যবস্থা করার সংস্থান ছিল। বাড়ির আর দুটো সন্তানের সাথে ওর অবস্থানের ফারাক ছিল স্বাভাবিক, সুষ্পষ্ট। কিন্তু তালেব কখনই নিজেকে বঞ্চিত ভাবে নি এখানে। বরং ঋন শোধ করার ক্ষুদ্র চেষ্টা হিসেবে পরিবারের টুকটাক কাজ করে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা থাকতো তার। আদর স্নেহের অভাব পায়নি কখনো। পরিবারের বাকী দু’সন্তানের সাথে একই স্কুলে ভর্তি করানো হলো ওকে। পড়ালেখায় মন ছিল না ওর। এসএসসি পরীক্ষা দিয়েই মোফাজ্জল সাহেবকে রেলে একটা চাকরি দিয়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ করে। মোফাজ্জল সাহেব ওকে অন্তত গ্রাজুয়েশন করার জন্য বুঝিয়ে ব্যর্থ হন।
চাকরির বাজার তখন এতটা প্রতিযোগিতাময় ছিল না। এতটা নোংরাও ছিল না পরিবেশ। মোফাজ্জল সাহেবও ততদিনে বেশ উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা হয়ে গেছেন। নিজের চেষ্টাতেই রেলওয়ে ট্রাফিক বিভাগে ছোট্ট একটা চাকরি দিয়ে দিতে পারলেন। বছর সাত আট চাকরি করার পর মোফাজ্জল সাহেবই নিজের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ার সাথে তালেবের বিয়েও দিয়ে দিলেন।
চার।
এই স্টেশন সেই স্টেশন ঘুরে ১৮/২০ বছর চাকরি করে তালেব সহকারী স্টেশন মাস্টার হলো। বছর সাতেক আগে স্টেশন মাস্টার গ্রেড-২ হিসেবে পরানপুর স্টেশনের দায়িত্ব পায়। তার পদ এবং অভিজ্ঞতায় অনেক বড় শহরে গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনে সে যেতে পারতো। কিন্তু অন্তর আর শিকড়ের টান তাকে এখানে টেনে এনেছে। কর্তৃপক্ষও তার ইচ্ছের মূল্য দিয়েছে। নিয়মিত অবসর নেয়ার পর লোকবল সংকটের কারণে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়ার পরও তাকে এখান থেকে সরায় নি।
এই স্টেশনে দায়িত্ব পেয়ে এক্সিডেন্ট রেজিস্টার বের করে ৭৩ সালের দূর্ঘটনার ইতিবৃত্ত জেনেছে সে। ….বড় মাস্টার ছুটিতে ছিল। দায়িত্বপ্রাপ্ত ছোট মাস্টারের খাঁমখেয়ালীতে ভুল সিগনালের কারণে দুটি ট্রেনের হেড-অন কলিশন হয়। তদন্ত রিপোর্টটি নথিতে আছে। রাত জেগে তাস খেলার অভ্যেস ছিল ছোট মাস্টারের, তাই ডিউটির সময়ে ঘুমিয়ে পড়ে সে। ৪৩ জন মারা যায়, আহত হয় শতাধিক। নিহতদের তালিকা আছে ফাইলে। আবু তাহের (৪০), জোহরা বেগম (৩২), সামিনা (৮)….নামগুলোতে অশ্রুসজল চোখে হাত বুলায় মাঝে মাঝে।
যেই রেল তাকে অনাথ করেছিল, সেই রেলই তাকে বেঁচে থাকার সংস্থান, তিন সন্তানের পরিবার গড়ে দিয়েছে। ছেলেমেয়েরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অনেক অনেক বড় অবস্থানে তারা আজ। বাবার সাথে দেখা হয় না খুব একটা। তালেবের অভিমান নেই। যেই রেললাইনের সাথে তার জীবন বাঁধা, সেটি ছাড়া তার জীবনের আগ্রহ কেন্দ্রবিন্দুতে আর কিছু নেই। বেশীদিন আগের কথা নয়, শায়লা যখন ইউটেরাস অপারেশনের জন্যে হাসপাতালে ভর্তি, জরুরি বার্তা এসেছিল- ‘‘ওয়াইফ সিরিয়াস, কাম শার্প।’’ হাজার হাজার যাত্রীর জীবনের কথা ভেবে সহকারীর উপর দায়িত্ব চাঁপিয়ে তৎক্ষণাত ছুটে যেতে পারেনি।
নিয়ম মেনে ঢাকা যেতে যেতে এ দুনিয়ায় আর দেখা হলো না স্ত্রীকে। শায়লার মৃত মুখে সে কোন অভিযোগ কিংবা অসুখীর ছাপ খুঁজে পায়নি। একমাত্র ও ই বুঝতো তালেবকে। কবর দেযার সময় শায়লা যেন কানে কানে বলে গিয়েছিল- ‘‘পিছুটান থেকে মুক্তি দিলাম তোমাকে…ফিরে যেও হাজার মানুষের কাছে…।” তবে সন্তানরা মেনে নিতে পারেনি বাবার এই অবহেলা। বিস্মৃত হয়নি ছেলেমেয়ে মানুষ করতে মায়ের প্রায় একার লড়াই। ভুলতে পারেনি মৃত্যুশয্যায় স্বামীকে একটি বার দেখার জন্য মায়ের আকূতি। অনেকবার তারা চেয়েছে, অবসর নিয়ে বাবা তাদের কাছে থাকুক। জীবনের সমান্তরাল দুটি রেখাকে সমান মূল্য দিয়ে মিলাতে পারেনি তালেব। মনের কষ্ট মনে চেপে পরদিনই কাজে ফিরে লাল-সবুজ পতাকা আর বাঁশি হাতে চেনা ‘তালেব মাস্টার’ হয়ে যায় আবার।
পাঁচ।
নাইন আপ স্টেশনে ঢুকলো। বেশ কয়েকজন প্যাসেঞ্জার নামলো আজ। উঠলো দু’চার জন। টিসি ফোনে পরের স্টেশনের ক্লিয়ারেন্স নিয়ে বের হয়ে আসলেন মাস্টার। সবুজ সিগনাল দিয়ে দিলেন। রাতের আঁধার ঘনিয়েছে, আবছা দেখা গেল প্যাসেঞ্জারের একটা দল ওয়েটিং রুমের দিকে গেল। যাত্রীরা ব্যবহার করুক আর না করুক- ওয়েটিং রুম, টয়লেট সবসময় সাফসূতরা থাকে এই স্টেশনে। আর দশটা স্টেশনের মত তালাবদ্ধ থাকে না। ওয়েটিং রুম থেকে নারী ও শিশুর কলরব শোনা গেল।
হুইসল দিয়ে ট্রেন পার হয়ে গেল। ট্রেনের টেইল লাইটটি চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে রইলেন। ‘‘সাবধানে চলিস বাবা, সিগনাল ঠিকঠাক মেনে চলিস, লাইনে থাকিস….” ট্রেনটি যেন তার সন্তান, ফিসফিস করে সাবধান করে চোখ ফেরান। রাত বারোটার দিকে একটা মেইল যাবে, স্টপেজ আছে। মাঝের সময়টা অবসর। জলিলকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে তালেব বাসায় যাবে। এশার নামাজ সেরে রাতের খাবার খেয়ে আবার চলে আসবে।
নিঃসঙ্গ মানুষ তিনি। তিন রুমের কোয়ার্টার। প্রায় সময় বাসার দরজা খোলাই থাকে। নামাজের মধ্যেই মৃদু ঠুক ঠাক আওয়াজ শুনলেন। ফখর আসতে পারে পানি নিয়ে, কিংবা কাজের মেয়েটা হয়তো। সালাম ফেরানোর সময় চোখের কোণ দিয়ে যা দেখলেন বিশ্বাস করার মত নয়!....একদল মানুষের আবছা মূর্তি তার পেছনে সারি দিয়ে দাঁড়ানো! সাদা পোশাক।
সময় কি শেষ হয়ে এলো তার? কারা এরা…..আল্লাহর ফেরেশতা! এসেছে কি তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য? চোখ দিয়ে দর দর করে পানি ঝরতে লাগলো। মুনাজাত ধরলেন, ‘‘হে আল্লাহ………….।’’
কঁচি দুটি হাত গলা জড়িয়ে ধরলো। আরেকটি ফেরেশতা শিশু কোলে এসে বসে পড়লো। মুনাজাত শেষ করে বাচ্চা দুটোকে সামলে পেছনে ফিরে দেখেন- তার দু’ছেলে এক মেয়ে তাদের স্ত্রী, স্বামী সন্তানদেরসহ দাঁড়িয়ে। ‘নাইন আপ’ থেকে নামা প্যাসেঞ্জার এরাই ছিল তাহলে- হিসাব মিললো তালেবের। নাতনী দুটোকে চুমোতে ভরিয়ে দিলেন। ওরা বললো, ‘‘দাদু, আমরা তোমার সাথে থাকতে এসেছি….।’’ ওদের পিতামাতার চোখে অনুমোদনের দৃষ্টি।
শোয়া এবং বসার ঘর ঘুরে দেখলেন, মেয়ে আর ছেলেবউরা মিলে সব ছবির মত গুছিয়ে ফেলেছে। এক অনির্বচনীয় আনন্দে শরীর মন ভেসে গেল তালেব মাস্টারের। অবশেষে তার ছেলেমেয়েরা তার কাজকে অনুমোদন দিল। পরিবার থেকে স্বীকৃতি মিললো তার চাকরি নামের এই তপস্যার। কিছুক্ষণের জন্য স্টেশন, রেললাইন, যাত্রীসেবা ভুলে কারো বাবা, কারো শ্বশুর, আর শিশুদের কাছে একটি বুড়োখোকা হয়ে গেলেন তালেব মাস্টার।
অস্ফূটে বেড়িয়ে এলো স্বগোক্তি, ‘‘আল্লাহ পৃথিবীতেই আমাকে বেহেশতের সুবাস পাইয়ে দিলো! …. আমার জান্নাত আজ এইখানেই।”
শেষ।
মহান সৃষ্টিকর্তা বোধহয় কিছু মানুষের জন্য পুরস্কার আলাদা করে রাখেন, পরজনমে দেবেন বলে। আরাম, স্বাচ্ছন্দ্য, সঙ্গসুখ….এই দুনিয়ায় তাদের জন্য প্রায় কিছুই বরাদ্দ রাখেন না।
পরদিন ভোরবেলা, ফজরের নামাজে সেজদারত অবস্থায় চলে গেলেন তালেব মাস্টার। নামাজে সৃষ্টিকর্তার সাথে বান্দার সরাসরি যোগাযোগ হয়। জানা গেল না, আল্লাহ কর্তৃক চির-ছুটি মঞ্জুরীর সময় লক্ষ যাত্রীর দায়িত্বভার সোপর্দের কী ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন তালেব মাস্টার? স্টেশন অরক্ষিত রেখে তিনি এভাবে চলে যান কী করে!
মাস্টারের বড় ছেলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে পরানপুরে যোগদান করতে এসেছিল। বাবাকে কাছে পাবার ইচ্ছেতে তদবির করেই সে এখানে পোস্টিং নেয়। সুখ সইলো না তাদেরও। বাবার সাথে সবাইকে নিয়ে একটি রাত কাটাতে না কাটাতেই সকালে ব্যস্ত হয়ে পড়লো পিতার শেষ সৎকার নিয়ে। সরাসরি কিছু না বললেও বাবার কিছু কিছু ইচ্ছা আভাসে ইঙ্গিতে জানতো বড় ছেলে। ১৮১/৩ কি.মি পোস্টের পাশের জমির মালিককে বুঝিয়ে কবরের জায়গাটুকু কেনা গেল।
সেখানেই শুয়ে দেহত্যাগী তালেব মাস্টার হয়তো ঘুরে বেড়ান লাইনে লাইনে, ছুটে চলেন ট্রেনের পিছু পিছু, পরের স্টেশন পর্যন্ত দিয়ে আসেন যন্ত্রযান বন্ধুদের। ট্রেনের শব্দ আর কম্পনে থরথর কাঁপে তার পলকা মাটির ঘর। সময়ের স্রোতে রেলপথের মাটি ধুলো প্রস্তর আর ইস্পাতে মিশে যান স্মৃতির পরশ রেখে।